যে কবিতাটি আবৃত্তি করে এমনকি মুখস্থ করতে গিয়ে চোখের জলে বুক ভাসাতে হয় কিংবা গভীর বেদনা অনুভূত হয়- সে কবিতাটিই হচ্ছে কাজলা দিদি। এতো সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা এ কবিতা যে, একান্ত শৈশব-কৈশোরেও হারিয়ে যাওয়া বোনকে ফিরে পাওয়ার হৃদয় নিংড়ানো গভীর আকুতি আর না পাওয়ার হাহাকার বেদনা জাগানিয়া সেই ‘বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক–বলা কাজলা দিদি কই?’
এ কবিতা পাঠে প্রতিটি বাঙালীর শৈশবকে আপ্লুত করেছে। গ্রামবাংলার শাশ্বত শ্যামল স্নিগ্ধরূপ এ কবিতায় অপূর্ব সুর ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত হয়েছে। গ্রামীণ জীবনের সাধারণ বিষয় ও সুখ–দুঃখগুলোকে সহজ–সরল ভাষায় সহৃদয়তার সঙ্গে তাৎপর্যমণ্ডিত করে প্রকাশ করেছেন কবি।
১ ফেব্রুয়ারি ছিল সেই কালজয়ী কবিতার কবি যতীন্দ্র মোহন বাগচীর মৃত্যু দিবস।
আমাদের সবুজশ্যামল বাংলার চিরন্তন সৌন্দর্য কবির দৃষ্টি আর মননকে এড়িয়ে যায়নি। এক বোনহারা ভাইয়ের আকুতির যে ছবি এ কবিতায় প্রস্ফুটিত সে যেন পরম মমতায় লালিত আমাদের বাঙালী পরিবারিক জীবনেরই নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি।
দিদিহারা একটা ছোট্ট মেয়ে, দিন রাত দিদিকে খুঁজে ফেরে। মায়ের আঁচল ধরে কত প্রশ্ন করে। মা দিদির কথায় আঁচলে মুখ লুকায়। হারিয়ে যাওয়া সেই দিদির নাম কাজলা।
আর সেই কবিতার নাম ‘কাজলা দিদি’। একজন কবির পরম সার্থকতা সাহিত্যের আসনে নিজের সুপ্রতিষ্ঠা। ‘কাজলা দিদি’ কবিতাটি তেমনই একটি রচনা যা এর রচয়িতা যতীন্দ্রমোহন বাগচীকে সাহিত্যের আসনে স্থায়ীভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
এ কবিতার গঠন, বাক্য ও শব্দ চয়ন শৈলী এতটাই যাদুমন্ত্রমুগ্ধতায় পূর্ণ যে, পরিণত বয়সেও এ কবিতাটি আবৃত্তি করলেও চোখের জলে কারনা বুক ভাসে?
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
যতীন্দ্রমোহন বাগচী নদীয়া জেলার জমশেরপুর গ্রামে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২৭ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস হুগলি জেলার বলাগড় গ্রামে।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতার ডাফ কলেজ (বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে বিএ পাস করেন। পরে বিভিন্ন সময়ে তিনি বিচারপতি সারদাচরণ মিত্রের সচিব, নাটোরের মহারাজার সচিব, কলকাতা কর্পোরেশনের লাইসেন্স-ইন্সপেক্টর, এফ.এন গুপ্ত কোম্পানির ম্যানেজারসহ বিভিন্ন পদে চাকরি করেন।
যতীন্দ্রমোহন অল্প বয়স থেকেই কাব্যচর্চা শুরু করেন। ভারতী, সাহিত্য প্রভৃতি বিখ্যাত পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হলে তিনি কবি হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
পরবর্তীকালে তিনি ১৯০৯ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত মানসী পত্রিকার সম্পাদক, ১৯২১ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত যমুনা পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক এবং ১৯৪৭-৪৮ সালে পূর্বাচল পত্রিকার সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের কবিদের অন্যতম যতীন্দ্রমোহন বাগচী পল্লিপ্রকৃতির সৌন্দর্য ও পল্লিজীবনের সুখ-দুঃখের কথা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সাবলীল ভাষা ও ছন্দে প্রকাশ করেছেন, যা সাধারণ পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী দাগ কাটে। তাঁর ‘কাজলা দিদি’ ও ‘অন্ধবধূ’ কবিতা দুটি সর্বাধিক জননন্দিত।
এই কালজয়ী কবিতার স্রষ্টা এই মহান কবির প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা।