এখনও বর্ষার পানি কানায় কানায় পূর্ণ হয়নি। তবু, করোনা প্রাদুর্ভাবকে সামনে রেখে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়েও কিশোরগঞ্জের নিকলী বেড়ি বাঁধ পর্যটন এলাকায় ঠেকানো যাচ্ছে না দেশের দূরদূরান্ত থেকে আগত দর্শনার্থী-পর্যটকদের।
শত-শত মোটরবাইকে করে কিংবা প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ইত্যাদি হাঁকিয়ে প্রতি শুক্রবার এখানে ভিড় করছেন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নান বয়সের ভ্রমণ বিলাসী অসংখ্য নারী-পুরুষ দর্শনার্থী-পর্যটক।
আর এতে সোশ্যাল ট্রান্সমিশনের কারণে বাড়ছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি।
আগন্তুকরা বলছেন, লকডাউন আর খাঁচাবন্দী পাখির মতো হোম কোয়ারেন্টিন থেকে বেরিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়া ছাড়া উপায় নেই। তাই তারা এ-ই হাওর পর্যটন এলাকাকে বেছে নিয়েছেন।
শুক্রবার বিকালে সরেজমিন পরিদর্শন কালে দেখা গেছে, নিকলী সদরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকালী সবক'টি প্রধান সড়কে পুলিশ পাহারা এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দর্শনার্থী ও পর্যটকদের ঠেকানোর ব্যবস্থা করছে প্রশাসন।
কিন্তু; কিছুতেই বাঁধা মানছেন না তারা। বেপরোয়া দর্শনার্থী পর্যটকরা স্থানীয় অপরিনামদর্শী লোকজনের সহায়তায় পথ পরিবর্তন করে বিকল্প পথে দলে দলে পর্যটন এলাকায় প্রবেশ করেছেন।
আর রাজধানী ঢাকা থেকে আগত বাইকারের দলতো যথারীতি ফিল্মি কায়দায় ছোট অলিগলি পথ এমনকি ক্ষেত-খামার মাড়িয়ে পর্যটন এলাকায় পৌঁছে নৌকা-স্পীড বোটে ঘুরে বেড়ানোসহ টিউব নিয়ে জল খেলিতে মেতে উঠে।
এক-ই অবস্থায় জেলা এবং আশপাশের জেলার লোকজনও স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের নিয়ে প্রবেশ করে মেতে উঠে আনন্দ কোলাহলে। এদের অধিকাংশই অপরিচিত লোকজনের সঙ্গেও নৌকা ভাড়া করে একই নৌকায় পরিবারের ছোট্ট শিশুদের নিয়েই এ-ই আনন্দ উৎসবে যোগ দিচ্ছেন।
এমন পরিস্থিতিতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই নিকলী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আসপিয়া সিরাতের নেতৃত্বে গঠিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পর্যটন এলাকায় গিয়ে হাজির হন।
এ সময় তিনি সামাজিক দূরত্ব রক্ষা না করে এবং স্বাস্থ্য বিধি অমান্যকারীদের আর্থিক জরিমানা করেন এবং অন্যান্যদের করোনাকালে এ পর্যটন এলাকায় না আসতে সতর্ক করে দেন।
এ সময় কথা হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আসফিয়া সিরাত সাতকাহনকে বলেন, এখানে পর্যটন কেন্দ্রটি গড়ে ওঠায় নিকলী উপজেলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এখানে অনেক বেকার লোকজন বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে নতুন জীবিকারও সন্ধান পেয়েছে। আমরা এ বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। কিন্তু; এই করোনা সংক্রমণের মহামারীর সময় এ ধরনের লোক সমাগমের কারণে সোশ্যাল ট্রান্সমিশন ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
আর এজন্য করোনা প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই এখানে দর্শনার্থী-পর্যটক সমাগম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ পাহারা বসিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি এবং মোবাইল কোর্টের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, বর্ষার পানির ঢেউয়ের প্রচণ্ড আঘাত থেকে সদর এলাকাকে রক্ষায় ২০০০ সালের দিকে ঘোড়াউত্রা নদী তীরে অবস্থিত কিশোরগঞ্জ হাওর উপজেলা নিকলীতে পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বেড়িবাঁধ তৈরি করে সরকার।
তারপর থেকেই উপচে পড়া বর্ষার পানির ঢেউয়ের প্রচণ্ড আঘাত থেকে রক্ষা পায় এলাকাটি।
কালক্রমে ওই বেড়িবাঁধ এলাকাটির সামনে বর্ষায় দিগন্তবিস্তৃত থৈ-থৈ পানি আর ঢেউয়ের খেলা, মুক্ত-নির্মল হাওয়া এবং অপরূপ নৈসর্গিকতা পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এখন সারা দেশের ভ্রমণ বিলাসী মানুষের পছন্দের পর্যটন এলাকা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এই নিকলী হাওর পর্যটন এলাকা।
আর এ এলাকাটি ঘিরে নতুন করে জীবিকার সন্ধান পায় নৌকা,স্পিট বোট চালক,হোটেল ব্যবসায়ীসহ এক শ্রেণির খেটে খাওয়া মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
এসব গুরুত্বের কথা বিবেচনায় নিয়ে ইতিমধ্যেই পর্যটন মন্ত্রণালয় ভাটিকন্যা কিশোরগঞ্জের এ এলাকাটিকে পর্যটন উপযোগী করে গড়ে তোলার পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে।
এ সময় ঢাকা থেকে ১৫ টি মোটরসাইকেল যোগে এখানে আসা বাইকার দলের রাকিব নামে একজনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, লকডাউন আর হোম কোয়ারেন্টিনে থেকে আমরা এখন কী যে "বোর ফিল" করছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা। তা-ই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে, মুক্ত বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে নৌকা -স্পীড বোটে ঘুরে বেড়াতে এবং জল ক্রীড়ায় মেতে ওঠতে এ পর্যটন এলাকাটিকে বেছে নিয়েছেন।
এ সময় তিনি দাবি করেন, করোনা কালের কারণে তারা সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্য বিধিও মেনে চলছেন।
মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক আর হাতে স্যানিটাইজার নিয়ে মায়ের সঙ্গে এ পর্যটন এলাকায় ঘুরতে আসা পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ঐশী জানায়, স্কুল বন্ধ, কারও সঙ্গে দেখা হয় না বহুদিন ধরে। ঘরে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তা-ই মায়ের সঙ্গে এখানে ঘুরতে এসে খুব ভালো লাগছে তার।
কিশোরগঞ্জ জেলা করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সচিব সিভিল সার্জন ডা. মো. মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন এভাবে এ পর্যটন এলাকায় ভিড় করলে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার যতই দোহাই দিক না কেনো, এতে সোশ্যাল ট্রান্সমিশন ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
সুতরাং; কঠোর হস্তে দর্শনার্থী ও পর্যটকদের ঠেকানোর কোনো বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।