ইন্দিরা যেভাবে গান্ধী হলেন

সাতকাহন ডেস্ক
ইন্ধিরা গান্ধী। ছবি: সংগৃহীত

১২ সেপ্টেম্বর ১৯১২ সালে বোম্বেতে ফিরোজ জিহাঙ্গির খান গান্ধী বা ফিরোজ গান্ধী নামে একটি পার্সি পরিবারে একটি ছেলের জন্ম হয়। ছেলেটির পূর্ব পুরুষরা পারস্য থেকে ভারতে এসে বসবাস শুরু করে।তারা ছিল পার্সি বা জরস্ত্রিয়ান ধর্মের অনুসারী। ফিরোজ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টির একজন নবীন সদস্য ছিলেন এবং এলাহাবাদে পার্টির কাজের সুবাদে ইন্দিরা এবং তাঁর মা কমলা নেহরুর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয় এবং নেহেরু পরিবারের খুব কাছের একজন হয়ে যান। ১৯৩৩ সালে তিনি ইন্দিরাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন ,তখন এটা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কমলা নেহেরু। ইন্দিরা নেহেরুর বয়স তখন মাত্র ১৬।১৯৩৬ সালে কমলা নেহেরু মারা যান এবং ইন্দিরা তখন খুব একা হয়ে যান। পিতা জওহরলাল তাকে অক্সফোর্ডে পাঠান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার জন্য।সেই সময় ফিরোজ গান্ধী ও অক্সফোর্ডে পড়াশুনা করতে গিয়েছিলেন।সেই সময়টাতেই ইন্দিরা এবং ফিরোজ খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে একে অপরের কাছে চলে আসেন।

সেই সময়েই ইন্দিরা তার পিতা জওহরলাল নেহেরু কে প্রায় ১০০ টা চিঠি পাঠিয়েছিলেন।চিঠিতে একটা মাত্র বাক্য লেখা থাকতো।কি সেই বাক্য ? বাক্যটা হচ্ছে "বাবা, আমি ফিরোজ কে ভালবাসি"।

হতভম্ব জওহরলাল কন্যার এই ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলেন।১৯৪২ সালের মার্চে তারা দুইজন বিয়ে করেন।জানা যায় বিয়েটা হয় হিন্দু ধর্ম মতে।ফিরোজ গান্ধিকে বিয়ের পরই ইন্দিরা নেহেরু হয়ে যান ইন্দিরা গান্ধী।

মহাত্মা গান্ধীর দ্বারস্থ হয়েও জওহরলাল নেহেরু তাদের বিয়েকে ঠেকাতে পারেননি। আন্তঃধর্মীয় বিয়ের বিরুদ্ধে তখন পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হতো।পরে অবশ্য তিনি তাদের সাদরে মেনে নিয়েছিলেন।

ইন্দিরা এবং ফিরোজ দম্পতির দুইটি সন্তানের জন্ম হয়।দুই জনই পুত্র সন্তান।রাজিব গান্ধী ও সঞ্জয় গান্ধী.

১৯৬০ সালে হার্ট অ্যাটাকে মারা জান ফিরোজ গান্ধী।ফিরোজ গান্ধী ছিলেন ভারতের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ দের একজন এবং ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক।

২।সঞ্জয় গান্ধী ১৪ ডিসেম্বার ১৯৪৬ সালে জন্ম গ্রহন করেন।সঞ্জয় গান্ধী ছিলেন ইন্দিরা ও ফিরোজ গান্ধীর কনিষ্ঠ পুত্র।বড় পুত্র রাজিব ছিলেন পেশাদার বিমান চালক ।কিন্তু সঞ্জয় অল্প বয়সেই কংগ্রেসের সাধারন সম্পাদক হয়েছিলেন।ইন্দিরাও পুত্র সঞ্জয়ের মধ্যে অসাধারণ রাজনৈতিক প্রতিভা দেখতে পান।একটা সময় দলে সঞ্জয় হয়ে উঠেন মায়ের থেকেও ক্ষমতাশালী। মায়ের বিরুদ্ধাচরণ করেন তিনি।এমনকি শোনা যায় ভিন্ন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।আতঙ্কিত ইন্দিরা গান্ধী ও কংগ্রেসের হর্তা কর্তারা।এরপর এলো সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ । ২৩ জুন ১৯৮০ সালে নতুন দিল্লির কাছে সাফদারজং এয়ার পোর্টের কাছে জরুরি অবতরণ করতে গিয়ে নিহত হন সঞ্জয় গান্ধী।পরে জানা যায় বিমানে বোমা বা বিস্ফোরক জাতীয় কিছু ছিল । যা মাঝ আকাশে বিস্ফোরিত হয়।ঘটনা স্থলেই মারা যান সঞ্জয় গান্ধী। তার সাথে আর একজন ছিল।তার নাম ক্যাপ্টেন সুবাস সাক্সেনা।তিনিও সঞ্জয়ের সাথে পুড়ে কয়লা হয়ে যান।পাঠক আশা করি বুঝতে পারছেন আড়াল থেকে কে কলকাঠি নেড়েছিল।হ্যাঁ তিনি সঞ্জয়ের পরম মমতাময়ি মা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী।ইন্দিরার নিকট ব্যাক্তির চেয়ে দল বড় হয়ে গেছিলো।সারভাইভাল ফর দি ফিটেস্ট। এই সারভাইভাল রাজনীতির সারভাইভাল।হুমায়ুন আহমেদের বাদশাহ নামদারের একটা ডায়ালগ মনে পড়ে যাচ্ছে।যারা রাজা বাদশাহ বা শাসক তাদের কোন পুত্র নেই , সন্তান নেই, ভাই নেই কিচ্ছু নেই।

যদিও এর আগে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল মার্চ ১৯৭৭ সালে ।একজন আততায়ি তার গাড়িবহর কে লক্ষ গুলি ছোড়ে।এটা ঘটেছিলো নতুন দিল্লির ৩০০ মাইল দক্ষিন পূর্বে, সঞ্জয় তখন নির্বাচনী প্রচারণায় ছিলেন।

১৯৫১ সালে ইন্দিরা ও ফিরোজের বিচ্ছেদ ঘটে।

ইন্দিরা গান্ধীর পুরো নাম ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী।রবীন্দ্রনাথ তার প্রিয় ছাত্রীর নাম দিয়েছিলেন প্রিয়দর্শিনী।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে সু-দৃঢ় অবস্থান গ্রহণকারী বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু মহান নেতা ইন্ধিরা গান্ধীর আজ মৃত্যু দিবস। মৃত্যুপূর্ব বক্তৃতায় ইন্দিরা গান্ধীর নিঃসংকোচ উচ্চারণ" আর আমার গর্ব আছে যে আমি পুরো জীবনটাই দেশের মানুষের সেবায় কাজে লাগাতে পেরেছি" 

উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বর শহরের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর বেশ কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তবে বেশিরভাগ স্মৃতিই আনন্দের নয়।

এই শহরেই তার বাবা জওহরলাল নেহরু প্রথমবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তারপরেই ১৯৬৪ সালের মে মাসে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

১৯৬৭ সালের নির্বাচনী প্রচারে এই শহরেই ইন্দিরা গান্ধীর দিকে একটা পাথর ছোঁড়া হয়েছিল, যাতে তার নাক ফেটে গিয়েছিল।

সেই ভুবনেশ্বর শহরেই ১৯৮৪ সালের ৩০শে অক্টোবর জীবনের শেষ ভাষণটা দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।

প্রতিটা ভাষণের মতোই ওই ভাষণও লিখে দিয়েছিলেন মিসেস গান্ধীর মিডিয়া উপদেষ্টা এইচ ওয়াই শারদা প্রসাদ।

কিন্তু ভাষণ দিতে দিতে হঠাৎই লেখা বয়ান থেকে সরে গিয়ে নিজের মতো বলতে শুরু করেন ইন্দিরা। তার বলার ধরনও পাল্টে গিয়েছিল সেদিন।

তিনি বলেছিলেন, "আমি আজ এখানে রয়েছি। কাল নাও থাকতে পারি। এটা নিয়ে ভাবি না যে আমি থাকলাম কী না। অনেকদিন বেঁচেছি। আর আমার গর্ব আছে যে আমি পুরো জীবনটাই দেশের মানুষের সেবায় কাজে লাগাতে পেরেছি বলে। আর শেষ নিশ্বাসটা নেওয়া পর্যন্ত আমি সেটাই করে যাব। আর যেদিন মরে যাব, আমার রক্তের প্রতিটা ফোঁটা ভারতকে আরও মজবুত করার কাজে লাগবে।"

কখনও কখনও বোধহয় শব্দের মাধ্যমেই নিয়তি ভবিষ্যতের একটা ইশারা দিয়ে দেয়।

ভাষণের শেষে যখন মিসেস গান্ধী রাজ্যপালের আবাস রাজভবনে ফিরেছেন, তখন রাজ্যপাল বিশ্বম্ভরনাথ পান্ডে তাকে বলেছিলেন, "একটা রক্তাক্ত মৃত্যুর কথা বলে আপনি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন।"

"আমি যা বলেছি, তা নিজের মনের কথা। এটা আমি বিশ্বাস করি," জবাব দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।

সেই রাতেই দিল্লি ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। খুব ক্লান্ত ছিলেন। সারা রাত প্রায় ঘুমান নি।

পাশের ঘরে সোনিয়া গান্ধী ঘুমচ্ছিলেন। ভোর প্রায় চারটে নাগাদ শরীরটা খারাপ লাগছিল সোনিয়ার। বাথরুমের দিকে যাচ্ছিলেন। সেখানে ওষুধও রাখা থাকত।

সোনিয়া গান্ধী নিজের বই 'রাজীব'-এ লিখেছেন, "উনিও আমার পেছন পেছন বাথরুমে চলে এসেছিলেন। ওষুধটা খুঁজে দিয়ে বলেছিলেন, শরীর বেশী খারাপ লাগলে যেন একটা আওয়াজ দিই। উনি জেগেই আছেন।"

সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।

কালো পাড় দেওয়া একটা গেরুয়া রঙের শাড়ি পড়েছিলেন মিসেস গান্ধী সেদিন।

দিনের প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্টটা ছিল পিটার উস্তিনভের সঙ্গে। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর ওপরে একটা তথ্যচিত্র বানাচ্ছিলেন সেই সময়ে। আগের দিন ওড়িশা সফরের সময়েও তিনি শুটিং করেছিলেন।

দুপুরে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যালিঘান আর মিজোরামের এক নেতার সঙ্গে।

সন্ধেবেলায় ব্রিটেনের রাজকুমারী অ্যানের সম্মানে একটা ডিনার দেওয়ার কথা ছিল মিসেস গান্ধীর।

তৈরি হয়েই ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসেছিলেন তিনি। দুটো পাউরুটি টোস্ট, কিছুটা সিরিয়াল, মুসাম্বির জুস আর ডিম ছিল সেদিনের ব্রেকফাস্টে।

জলখাবারের পরেই মেকআপ ম্যান তার মুখে সামান্য পাউডার আর ব্লাশার লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তখনই হাজির হন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাক্তার কে পি মাথুর।

রোজ ওই সময়েই মিসেস গান্ধীকে পরীক্ষা করতে যেতেন তিনি। ভেতরে ডেকে নিয়েছিলেন ডাক্তার মাথুরকে।

হাসতে হাসতে বলেছিলেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রেগান কী রকম অতিরিক্ত মেকআপ করেন, যখন ৮০ বছর বয়সেও তার মাথার বেশির ভাগ চুল কালোই রয়েছে।

ঘড়িতে যখন ন'টা বেজে দশ মিনিট, ইন্দিরা গান্ধী বাইরে বের হলেন। বেশ রোদ ঝলমলে দিনটা।

তবুও রোদ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে আড়াল করতে সেপাই নারায়ণ সিং একটা কালো ছাতা নিয়ে পাশে পাশে হাঁটছিলেন।

কয়েক পা পেছনেই ছিলেন ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ান আর তারও পেছনে ছিলেন ব্যক্তিগত পরিচারক নাথু রাম।

সকলের পেছনে আসছিলেন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার, সাব ইন্সপেক্টর রামেশ্বর দয়াল।

ঠিক সেই সময়েই সামনে দিয়ে এক কর্মচারী হাতে একটা চায়ের সেট নিয়ে পেরিয়ে গিয়েছিলেন। ওই চায়ের সেটে তথ্যচিত্র নির্মাতা পিটার উস্তিনভকে চা দেওয়া হয়েছিল।

ওই কর্মচারীকে ডেকে ইন্দিরা বলেছিলেন মি. উস্তিনভের জন্য যেন অন্য আরেকটা চায়ের সেট বার করা হয়।

বাসভবনের লাগোয়া দপ্তর ছিল আকবর রোডে। দুটি ভবনের মধ্যে যাতায়াতের একটা রাস্তা ছিল।

সেই গেটের সামনে পৌঁছে ইন্দিরা গান্ধী তার সচিব আর কে ধাওয়ানের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

মি. ধাওয়ান তাকে বলছিলেন যে ইন্দিরার নির্দেশমতো ইয়েমেন সফররত রাষ্ট্রপতি গিয়ানী জৈল সিংকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে তিনি সন্ধ্যে সাতটার মধ্যেই দিল্লি চলে আসেন। পালাম বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপতিকে রিসিভ করে সময়মতো যাতে রাজকুমারী অ্যানের ভোজসভায় পৌঁছাতে পারেন ইন্দিরা, সেই জন্যই ওই নির্দেশ।

হঠাৎই পাশে দাঁড়ানো নিরাপত্তাকর্মী বিয়ন্ত সিং রিভলবার বার করে ইন্দিরা গান্ধীর দিকে গুলি চালায়।

প্রথম গুলিটা পেটে লেগেছিল। ইন্দিরা গান্ধী ডান হাতটা ওপরে তুলেছিলেন গুলি থেকে বাঁচতে। তখন একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে বিয়ন্ত সিং আরও দুবার গুলি চালায়। সে-দুটো গুলি তার বুকে আর কোমরে লাগে।

ওই জায়গার ঠিক পাঁচ ফুট দূরে নিজের টমসন অটোমেটিক কার্বাইন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সতবন্ত সিং।

(কৃতজ্ঞতা : বিবিসির হিন্দি বিভাগের প্রতিবেদক রেহান ফজল ও আগরতলা, ত্রিপুরার সাংবাদিক প্রসেনজিৎ দাস )