এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রাখার শপথ কৃষকদের

এ টি এম নিজাম

সম্ভাব্য খাদ্যাভাব ( দুর্ভিক্ষ)  মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক ইঞ্চি জমিও পতিত না থাকার  নির্দেশনা বাস্তবায়নে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর একযোগে মাঠের কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছে। অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনে প্রণোদনা-পুনর্বাসনসহ বহুমাত্রিক সহযোগিতার হাত বাড়ানোর আশ্বাসে উজ্জীবিত কৃষক সমাজ । কৃষকরা বলছেন, এবার অবহেলিত কৃষি ক্ষেত্রে নজির বিহীন গুরুত্ব প্রদান  এবং মূল্যায়ন তাদের অতিরিক্ত  খাদ্য শস্য উৎপাদনে বাড়তি অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। তবে, বাস্তবে  এখনও এসব আশ্বাসের সুফল না মেলায় হতাশ মাঠ পর্যায়ের প্রকৃত কৃষক। উপরন্তু ; কৃষক পর্যায়ে খাদ্য শস্যের  উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিতে ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে অস্থায়ী  ভ্রাম্যমাণ সরকারি ক্রয় কেন্দ্র স্থাপনের কর্মসূচি হাতে নেয়ার দাবি ভুক্তভোগী কৃষক সমাজের। 

জানা গেছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বৃহত্তর হাওরাঞ্চলের "গেটওয়ে" এবং বোরো ফসলের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত খাদ্য শস্যে উদ্বৃত্ত জেলা  কিশোরগঞ্জ। এ জেলার ১৩ টি উপজেলায় প্রচুর বোরো এবং আমন-আউশ ধান উৎপাদন হয়ে থাকে। কিন্তু ; অনেক দিন  ধানের উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় খাদ্য শস্য উৎপাদনের প্রতি অনেকাংশেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে কৃষক সমাজ। তারা বিকল্প অন্যান্য  লাভজনক ফলনের প্রতি ঝুঁকে পরছিলেন। 

আর এ কারণে খাদ্য শস্যপর মৌসুমে অনেক জমি পতিত পড়ে থাকতো। এ ছাড়া অনাবৃষ্টি-খড়া ও অকাল বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও লোকসান গুনতে হয় তাদের। এমন পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের (দুর্ভিক্ষ) আশঙ্কায় সরকারের এমন কৃষক বান্ধব কর্মসূচি এবং প্রণোদনার আশ্বাসে  এবার অতিরিক্ত খাদ্য শস্য উৎপাদনে উজ্জীবিত কিশোরগঞ্জের কৃষক সমাজ।

সরকারের প্রযুক্তি নির্ভর কৃষিক্ষেত্র বিনির্মান কর্মসূচীর আওতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমন ও বোরো ফসল কর্তন ও মাড়াইয়ে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধায়  অত্যাধুনিক ধানকাটা ও মাড়াই যন্ত্রও সরবরাহ করা হয়েছে অনেক আগেই।

এ ছাড়া এবার  সরকার প্রধানের ( প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার)  এক ইঞ্চি জমিও পতিত না থাকার বার্তা নিয়ে প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে জেলা প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর কর্মকর্তাগণ প্রতিটি উপজেলায় কৃষক সমাবেশের আয়োজন  করছে। কৃষকদের  শপথ বাক্য পাঠ করাচ্ছেন এক ইঞ্চি জমিও পতিত না রাখার। 

ইতিমধ্যেই একদিকে বোরো ফসল রোপণ এবং অন্যদিকে কোথাও কোথাও  আমন ফসল কর্তনের পালা শুরু হচ্ছে। কিন্তু ; আমন ক্ষেতে কীটনাশক দিয়ে  পোকা দমন করতে না পারায়  এবং বোরো জমিতে অধিক মূল্যের সার না দিতে পেরে হতাশায় ভুগছেন অনেক কৃষক। রয়েছে প্রণোদনা না পৌঁছার ক্ষোভও। উপরন্তু ; রয়েছে রাতের অন্ধকারে  গোয়ালের গরু এবং ক্ষেতের পাকা আমন ধান চুরি করে কেটে নেওয়ারও বাড়তি যন্ত্রণা।

সরকারের এমন কৃষক বান্ধব কর্মসূচিকে সামনে রেখে সরেজমিন পরিদর্শন কালে কথা হয় কিশোরগঞ্জ জেলার  বোরো শস্যের ভাণ্ডার খ্যাত অন্যতম হাওর উপজেলা মিঠামইনের ঘাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে। এ সময় তিনি সাতকাহনকে জানান, সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সরকারের এমন কৃষক বান্ধব কর্মসূচিতে কৃষক সমাজ উজ্জীবিত হয়েছে বটে। তবে, সময়মতো  ভর্তুকি ও প্রণোদনার বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে উপযুক্তদের নিয়ে  পক্ষপাতহীন  সুষম বণ্টন ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে। কেননা ; শ্রমে ঘামে সোনার ফসল ফলানো  কৃষকদের  রয়েছে তিক্ত  অতীত অভিজ্ঞতা। বাজারে ধান ও চালের যথাযথ মূল্য থাকলেও মধ্যস্বত্বভোগী প্রভাবশালী ব্যবসায়ী  ও চালকল মিল সিন্ডিকেটের কারণে তারা কখনোই উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে না। এ কারণে বেশ কিছুদিন ধরে এমন পরিস্থিতির শিকার কৃষকগণ ধান চাষের পরিবর্তে বিকল্প লাভজনক  ফসল উৎপাদন কিংবা মাছের খামার ইত্যাদিতে মনোযোগী হয়ে উঠছিল। এ-সব কারণে অনেক খাদ্য শস্যের জমি দীর্ঘদিন ধরে পতিত রেখে আসছিল কৃষক। তিনি আরও মনে করেন, উপরন্তু ; রয়েছে পূঁজি সমস্যা। এ-সব খাদ্য  শস্য উৎপাদনকারী কৃষকদের মধ্যে স্বল্প সুদে এবং  সহজ শর্তে উপযুক্ত ঋণ বিতরণও জরুরি। খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ-সব উদ্যোগ নেয়া জরুরি। কারণ এখনই চলছে এ অঞ্চলের প্রধান খাদ্য শস্য বোরো ফসল আবাদের ভরা মৌসুম। 

অপরদিকে, এবার তুলনামূলক উঁচু জমিতে আবাদকৃত  আমন শস্যের  অনেক এলাকায় কর্তন শুরু হয়েছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এ-সব খাদ্য শস্য গোলায় ওঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার আচমিতা ইউনিয়নের আছমিতা, জামষাইট ও পাইকশা গ্রাম এলাকার আমন চাষীদের সঙ্গে কথা হলে মিলেছে বিপরীত চিত্র। পাইকশা গ্রামের মাহমুদ কামাল, মধ্যপাড়া গ্রামের ফতেহ আলী এবং জামষাইট গ্রামের আবদুল কদ্দুস জানান, তারা কখনও ভর্তুকির বীজ, সার ইত্যাদি পাননি। এলাকার বিশেষ শ্রেণিভুক্ত কিছু লোকজন এ-সব সুবিধা পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া এবার পোকার আক্রমণে তাদের  অধিকাংশ আমন ফসলে চিটা হওয়ায় উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাবে। 

এ ব্যাপারে কথা হলে কিশোরগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর উপ-পরিচালক মো: আবদুস সাত্তার সাতকাহনকে জানান, কিশোরগঞ্জ জেলা এমনিতেই দেশের অন্যতম খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী এবার যাতে এক ইঞ্চি জমিও পতিত না থাকে সেজন্য জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম প্রতিটি উপজেলায় গিয়ে সমাবেশ করে কৃষকদের মধ্যে এ বার্তা দিয়ে এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি ও পতিত না থাকে সেজন্য কৃষকদের শপথ করাচ্ছেন।এক-ই সঙ্গে চলছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর বিরামহীন কর্মযজ্ঞ। 

কিশোরগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর তথ্যানুযায়ী খাদ্য শস্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জ জেলায় প্রতি বছর ১ লাখ ৬৭ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ফসল আবাদ এবং সাড়ে ১০ লাখ মেট্রিক টন বোরো ফসল উৎপাদন হয়ে থাকে। এ ছাড়া ৮২ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমিতে আমন ধান আবাদ এবং  সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন আমন ধান উৎপাদন হয়ে থাকে। ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে আউশ ধান  আবাদ  এবং ৯৬ হাজার মেট্রিক টন আউশ ধান উৎপাদন হয়ে থাকে । 

কিশোরগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর উপ-পরিচালক মোঃ আবদুস সাত্তার এবার বোরো ফসল আবাদের এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নজিরবিহীনভাবে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।